প্রযুক্তির আড়ালে ঢাকা পড়ছে লোক-সংস্কৃতির টুসু

Malay Singha
0

স্কাই বাংলা: পৌষ সংক্রান্তি মানেই বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বেলপাহাড়ি, ঝাড়গ্রামের অন্যতম বড় লোকসংস্কৃতি টুসু পরব। বর্তমান প্রযুক্তির আড়ালে ঢাকা পড়েছে লোকসংস্কৃতির টুসু-ভাদু-ঝুমুর। একটা সময় ছিল যখন সন্ধ্যা নামলেই শিল্পীর বিভিন্ন সুরে মুখরিত হয়ে উঠতো লালমাটির বিভিন্ন পাড়াগুলি। জোর কদমে চলত লোকসংস্কৃতি টুসু,ভাদু ঝুমুরের,রেওয়াজ। সে সব দিন আজ অতীত। প্রবাহমান কাল চক্রের আবর্তনে বদলেছে সময়, বদলেছে সমাজ-সংস্কৃতি। গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে দ্রুত কমেছে রেওয়াজ। তবুও রাঢ় বাংলার প্রাচীন সংস্কৃতির অন্যতম ধারা টুসু গান আজও টিকে রয়েছে বাঁকুড়ার বিভিন্ন পাড়া গ্রামে। বর্তমান মোবাইলের যুগে আগের মত এতটা রেওয়াজ নেই। জৌলুস হারিয়েছে বাঁকুড়ার টুসু পরব। অনেকের মতে টুসু মা লক্ষীর লৌকিক রূপ। লৌকিক দেবী, তাই তার আরাধনায় আড়ম্বরের তুলনায় আচারের প্রভাব বেশি। পৌষ মাস জুড়ে প্রতি সন্ধ্যায় পোড়ামাটির তৈরী বিশেষ ধরনের টুসু-খোলা মূলত গাঁদা ফুল দিয়ে সাজিয়ে তার চারিদিকে বসে গানের মাধ্যমে টুসুর আরাধনা করা হয়। প্রসাদ হিসেবে দেওয়া হয় মুড়ি-মুড়িকি, খই-মোয়া, বাতাসা। সেই সঙ্গে ঝুমুরের সুরে আঞ্চলিক ভাষায় শব্দের পর শব্দ বসিয়ে তৈরি হয় গান। যুগে যুগে নানা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা মিশে যায় গানে। গানের মধ্যে ফুটে উঠে দৈনিক জীবনের সুখ-দুঃখ, অভাব-অভিযোগের নানা কথা। তাদের বোলে - 
"আইলো সখি যাবি যদি বাঁকুড়ার বাজারে
 একা একা টুসু আমার যাবেক কি করে ?"

"আমার টুসু মুড়ি ভাজে, চুড়ি ঝলমল করে গো

উয়ার টুসু হ্যাংলা মিয়া,আঁচল পাতে মাগে গো !"


"যাব টুসু মিতের কাছে থাকবি শুধু তুই,

খেলবো ভালোবাসার খেলা আঁকড়ে ধরে ভুঁই!"

টুসু ভাসান, ছবি- ইন্টারনেট 
আর এই গানের সুর মহিলাদের মুখে মুখে এক প্রজন্ম থেকে সঞ্চারিত হয় আরেক প্রজন্মে। এখন বর্তমান প্রজন্ম এইসব রেওয়াজ ছেড়ে ইন্টারনেট সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যস্ত। মুখ থুবড়ে পড়েছে বাঁকুড়ার লোকসংস্কৃতির টুসু,ভাদু,ঝুমুর। তবে এই টুসু উৎসব কে নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা হয়েছে। কোনও গবেষকের কাছে টুসু উৎসবে গ্রাম বালিকার পুতুল খেলার প্রাধান্য বেশি, কারও মতে প্রাথমিক পর্যায়ে টুসুর কোনও মূর্তি প্রচলিত ছিল না। কালক্রমে তা চালু হয়। আবার কেউ মনে করেন টুসু নবান্ন নয়, তা আসলে আদিম জনজাতির শস্যকে পুর্নজীবন দানের উৎসব। কোল গোষ্ঠীর টুসাউ শব্দের সঙ্গে টুসুর মিল থাকতে পারে বলে মনে করেন কেউ কেউ। টুসাউ মানে টাটকা ফুলের গোছা। আর চিরাচরিত টুসু উৎসবেও মূর্তির বিশেষ স্থান ছিল না। ছিল ফুল আর কাগজের ফুল দিয়ে তৈরী চৌদলের ব্যাবহার। চৌদল বলতে বাঁশ আর কাগজ দিয়ে তৈরী ছোট মন্দিরের মতো কাঠামো। পুরুলিয়ার দিকে এখনও এই ধরনের চৌদল ব্যবহার হয়। আবার ধান কেটে ঘরে তোলার পরে এই উৎসবকে অনেকে অধিক ফলন বা সন্তান লাভের কামনা ইত্যাদি নানা উদ্দেশ্যসাধক ব্রত বলে মনে করেন। কেউ কেউ এর মধ্যে লক্ষ্মীব্রতেরও ছায়া দেখতে পান। তবে ফসল ঘরে তোলার পরে ধন্যবাদ জ্ঞাপনকারী উৎসব হিসেবে টুসুকে ব্যাখ্যা করেন অধিকাংশ গবেষক। টুসু নিয়ে নানা বিয়োগান্তক গল্প প্রচলিত রয়েছে। সব ক্ষেত্রেই টুসুর মৃত্যুর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে স্থানীয় নদী। তাই টুসু পরবের অন্যতম অনুষঙ্গ টুসুর বিদায় বা ভাসান। এই ভাসান পরবে আগে সারা রাত ধরে টুসুর গান করে মহিলারা। বেশিরভাগ গবেষকই মনে করেন, প্রাথমিক পর্যায়ে টুসুর মূর্তি বলে কিছু ছিল না। সঙ্গীত নির্ভর বিমূর্ত এই লোক উৎসব ক্রমে বির্বতিত হয়ে মূর্তি কেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। টুসুর মূর্তিও সাধারণ পুতুলের মূর্তি থেকে ধীরে ধীরে লক্ষ্মী প্রতিমার রূপ নিয়েছে।
টুসু মূর্তি, ছবি- ইন্টারনেট 
তবে এ সবই ইতিহাস। মোবাইল আর নেটের যুগে টুসুর সাবেক গান আর নতুন প্রজন্মকে টানছে না। টুসুর গান বা টুসুর চৌদল নিয়ে দিনের পর দিন কমছে উৎসাহ। কারণ সেই সব ছেড়ে বর্তমান প্রজন্ম মেতে উঠেছে মোবাইল ফোনে। টুসুর দিকে এখন তেমনভাবে আর কারও খুব একটা গুরুত্ব নেই। ফলে কমে গিয়েছে এই পরবের জৌলুসও। কবি ত্রিলোচন ভট্টাচার্য বলেন, লোকসংস্কৃতির পিঠস্থান রূপেই বহুল প্রচলিত বাঁকুড়া। আর এই লাল মাটির আকাশ বাতাস সর্বত্রই মিশে রয়েছে টুসু,ভাদু,ঝুমুর। যদিও বর্তমান প্রযুক্তি ও সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে টুসু, ভাদু, ঝুমুর গান কিছুমাত্রায় অবলুপ্তির পথে পা রেখেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাঁকুড়ার লোকসংস্কৃতি হারিয়ে যায়নি। এখনো বাঁকুড়ায় টুসু পুজো হয়। টুসু-ভাদুকে বাঁকুড়ার মানুষ মেয়ে হিসাবে পালন করে। কাজেই টুসু ভাদু যে হারিয়ে গেছে তা কিন্তু নয়। তবে লোকসংস্কৃতির টুসু গানকে চাঙ্গা করতে সরকারি সহায়তা একান্ত প্রয়োজনীয়।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
To Top