মলয় সিংহ, বাঁকুড়া : নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর স্পর্শ করা চেয়ার আজও দেবতার আসনে পুজো করে গঙ্গাজলঘাটির কর্মকার পরিবার। সাধারণ একটা কাঠের চেয়ার। তাকে ঘিরেই জড়িয়ে রয়েছে একরাশ স্মৃতি। থাকবে নাই বা কেন! এই চেয়ারেই যে একদিন বসেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। তারপর থেকে আর কেউ কোনও দিন ওই চেয়ারে বসার কথা স্বপ্নেও ভাবেননি। বাঁকুড়ার গঙ্গাজলঘাটি ব্লকের দেশুড়িয়া গ্রামের কর্মকার পরিবারের ঠাকুর ঘরেই তার ঠাঁই হয়েছে সেই কবে থেকে। সেখানে দেবজ্ঞানে পূজিত হয় নেতাজির স্মৃতি বিজড়িত চেয়ারখানা। আজও রোজ নিয়ম করে ফুল দেন পরিবারের সদস্যরা। প্রতি বছর ২৩ জানুয়ারি নেতাজির জন্মদিনেও নিবেদন করা হয় বিশেষ শ্রদ্ধা।
সালটা ছিল ১৯৪০। ভারতবর্ষ তখনো পরাধীনতার শিকলে বন্দি। ভারতকে অত্যাচারী ব্রিটিশদের হাত থেকে রেহাই দেওয়ার জন্য বহু দেশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে ছুটেছেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। বাদ পড়েনি লালমাটির বাঁকুড়াও। ১৯৪০ সালের এপ্রিল মাসে ফরওয়ার্ড ব্লকের সাংগঠনিক কাজে বাঁকুড়ায় আসেন নেতাজি। দিনটা ছিল ১৯৪০ সালের ২৮ এপ্রিল,রবিবার। সাংগঠনিক কাজে বাঁকুড়া সফরে এসেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। একটি সভা করেছিলেন গঙ্গাজলঘাটিতে। ওই সময় ডেকোরেটারের চল ছিলনা। মঞ্চে বিশিষ্টদের বসার জন্য চেয়ারের বন্দোবস্ত করতে হত আশপাশের বাড়ি ও দোকান থেকে চেয়েচিন্তে। সেভাবেই বেশ কিছু চেয়ার জোগাড় করা হয়েছিল। তবে নেতাজির জন্য রানিগঞ্জ থেকে আনা হয়েছিল আলাদা সোফাসেট। তাতে অবশ্য বসেন নি সুভাষচন্দ্র। অন্যদের জন্য কাঠের চেয়ার ছিল। তাই তিনিও একটি কাঠের চেয়ার টেনে নিয়েই সকলের সঙ্গে বসেছিলেন মঞ্চে। যে চেয়ারটিতে তিনি সেদিন বসেছিলেন সেটি আনা হয়েছিল স্থানীয় চিকিৎসক রামরূপ কর্মকারের চেম্বার থেকে। তাঁর চেয়ারে স্বয়ং নেতাজিকে বসতে দেখে আপ্লুত হয়েছিলেন চিকিৎসক। তারপর সভা শেষ হতে কাঠের ওই চেয়ারটিকে মাথায় করে দেশুড়িয়া গ্রামে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান রামরূপ। সেই থেকেই নেতাজির স্পর্শ পাওয়া চেয়ারটি সযত্নে সাজানো রয়েছে কর্মকার পরিবারের ঠাকুর ঘরে। আট দশক পরেও শ্রদ্ধায় ভাটা পড়েনি বিন্দুমাত্র।
ফুল,মালা দিয়ে আজীবন চেয়ারটিকে পুজো করে গিয়েছেন চিকিৎসক রামরূপ কর্মকার। তাঁর অবর্তমানেও রীতি ধরে রেখেছেন পরিবারের সদস্যরা। রামরূপের পরিবারের এক সদস্য বলেন'এই চেয়ারের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে নেতাজির স্মৃতি। সেদিন নেতাজির সভা শেষ হওয়ার পর দাদু চেয়ারটি মাথায় করে আমাদের বাড়িতে এনেছিল। তারপর থেকে এই চেয়ারে কেউ কোনও দিন বসেনি। তার স্থান হয়েছে একেবারে ঠাকুর ঘরে। দাদু আজীবন শ্রদ্ধা ভরে চেয়ারটিকে পুজো করে গিয়েছেন। পরিবারের বর্তমান সদস্যরাও সেই নিয়ম ধরে রেখেছে।' প্রতি বছর ২৩ জানুয়ারি ঠাকুর ঘর থেকে বের করে বাড়ির উঠোনে আনা হয় চেয়ারটি। সেখানে নেতাজির ছবিতে ফুল,মালা দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন পরিবারের লোকজন।
অন্যদিকে, ১৯৪০-এর ওই দিন নেতাজি ফেরার সময় গঙ্গাজলঘাটির বিড়রা গ্রামের বাসিন্দারা রাস্তায় শুয়ে পড়ে তাঁর গাড়ি থামিয়েছিলেন। স্থানীয়দের আবদারে সেখানে পাঁচ মিনিট বক্তৃতা করেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। পরবর্তীতে সেখানে নেতাজির স্ট্যাচু বানিয়েছে স্থানীয় ক্লাব। ২৩ জানুয়ারি দিনটি পালিত হয় শ্রদ্ধা ভরে।